মো.সাইদুর রহমান,কলাপাড়া( পটুয়াখালী) প্রতিনিধিঃ-
দিনের আলো একটু একটু দেহা দিলেই দেহি ডোবায়,খালে বিলে মরা মানুষের লাইন। সবাই উচকাইয়া উচকাইয়া নিজের বাপ,মা, আত্মীয় স্বজনদের খুইজ্জা লইয়া গেছে। বাকী যত মরা মানুষ আছিল সব লাঠি দিয়া হোতো( স্রোতে) ভাসাইয়া দিছি। কি যে খারাপ লাগছে তা ভাষায় বলার মত না। বাতাস আর পানিতে চোহের সামনে দিয়া ভাসাইয়া লইয়া গেছে আপন মানুষগুলা। বাড়ি ঘর সব তচনচ হয়ে গেছে। খাবার আর পানিতে যে কি কষ্ট করছি তা বলার মত না। আমি গাছের সাথে বাইজ্জা থাকায় জানটা বাইচ্চা আছে। এমনি ভাবেই ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের কথাগুলে বলছিল কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামের বাসিন্দা বৃদ্ধ গোলাম মাওলা।
কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই সব কিছুই পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে চারিদিকে শুধুই বাঁচার আকুতি আর লাশের গন্ধ। পানিতে রাস্তা ঘাট তলিয়ে গেছে আর আশ্রয়স্থল নিমিষেই শেষ হয়ে গেছে৷ দিনটির কথা মনে পড়লে ঘুমের মধ্যে জেগে উঠে এ এলাকার মানুষ।
তথ্যমতে, উপকূল জুড়ে আত্বনাদ সৃষ্টিকারী সেই ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের নাম ‘হারিকেন’। ৩০ ফুট উচ্চতার এ জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় মানুষ, ঘরবাড়ি আর পশুপাখি। ফলে অনাহারে আর খোলা আকাশের নিচে বসবাস করে হাজার হাজার মানুষ ।
সুত্রমতে আরো বলছে, জাতিসংঘ বাংলাদেশের উপর বয়ে যাওয়া ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় হারিকেনকে প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। আঘাত হানার সময় ঘূর্ণিঝড়টির বাতাসের গতিবেগ ছিল ২৫০ কিঃমিঃ। সরকারি হিসেবে মতে, এতে প্রায় ৫ লাখ মানুষের প্রাণহানি হয়। তবে বেসরকারি মতে সেটি দ্বিগুণ।
প্রাকৃতিক দূর্যোগের মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠা এ এলাকার মানুষের এখনো জীবন চলে অনিশ্চিতভাবে৷ ২০০৭ এ সিডরের আঘাতে তচনচ করে ফেলছিল উপকূলের বেড়িবাঁধ। বাকী যা ছিল তাও ইয়াসে শেষ করে দিয়েছে। এখনো বেঁড়িবাধের পূর্নতা পায়নি উপকূলের মানুষ।
কথা হয় পাখিমারা গ্রামের সগির খানের সাথে, তিনি বলেন, চোখের সামনে দিয়া কত মানুষ পানিতে ভাইসা গেছে৷ কত কান্নাকাটি মানুষের৷ তা বলা যায়না। এখন এগুলো মনে পড়লে শরীরে ঝিঁঝি মারে।
সত্তার মুন্সি বলেন, চারিদিকে শুধুই লাশের গন্ধ। যে যেভাবে পারছে মানুষ দাফন দিয়ে রাখছে৷ আমি কত লাশ আন্ধারমানিক নদীতে ভাসাইয়া দিছি তার অন্ত নাই।
ইঞ্জিনিয়ার সাইফুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমার দাদু অনেক স্মৃতি শেয়ার করছে ৭০ রের বন্যা নিয়ে৷ আমরা ভয়ে আর শুনিনি। উপকূলে যেভাবে প্রাকৃতিক দূর্যোগের ঘনঘটা বেশি থাকে কিন্তু বেড়িবাঁধ নড়বড়ে। বড় কোন দূর্যোগ আসলে এক ধাক্কায় শেষ হয়ে যাবে এলাকা।
তাহের মুন্সি বলেন, বন্যা শেষে লাশ লাশ। এক জনের গায়ে আরেকজন। এভাবে খালে বিলে সব জায়গায়। সেই দিনের কথা ভুলতে পারিনা এখনো। আপনজন হারিয়েছি আমি। এ দিনটির কথা বর্তমান প্রজন্ম ভুলে গেছে। এ দিনটির কথা মনে রাখতে একটি সরকারি দিবস ঘোষণার দাবী জানাই।
চোখের সামনে স্বজন হারানোর মত নিষ্ঠুরতা কুঁড়ে কুঁড়ে শেষ করে দেয় উপকূলবাসীদের। উপকূলবাসীর প্রাণের দাবী ১৯৭০ এ বন্যাকে ঘিরে একটি সরকারি দিবস ঘোষণা করা হোক।
বেসরকারি ভাবে উপকূল দিবস পালনের প্রবক্তা ও উপকূল বন্ধু সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম মন্টু বলেন, আমরা বিগত দিনে দিবসটি পালন করে বিভিন্ন দপ্তরে জানান দিয়েছি। ঝড় বন্যায় উপকূল নিয়ে কথা হয় কিন্তু তাদের জন্য করা হয় না কিছু। ৭০ এ যে বন্যা হয়েছে তাতে লক্ষলক্ষ মানুষের প্রাণহানি হয় তাদের স্মরণে এবারও প্রায় ৫০ যায়গায় পালিত হবে বেসরকারি ভাবে উপকূল দিবস। সেখানে তাদের ভয়াবহতা তুলে ধরে দোয়া করা হবে।